Tuesday, June 30, 2015

স্বাধীনতা সুরক্ষায় আমাদের করণীয় - প্রফেসর মোশতাক আহমদ


হাজার বছর ধরে বিদেশী শাসন শোষণে জর্জরিত বাংলার জনগণ অধীর প্রত্যাশায় কাল গুণছিলো লাঞ্ছনা-বঞ্চনার অবসানের প্রত্যাশায়। প্রত্যাশায় ছিলো কবে তাদের মুক্তি ঘটবে, কবে তারা সত্যিকারের মানুষ হিসেবে সামজ-সংসারে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে।কবে তারা মৌলিক অধিকার ভোগ করতে পারবে, জীবনে আসবে সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্য।

অবশেষে বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠি ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নেবার প্রাক্কালে ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে ভারতীয় মুসলিম জনগণের দাবি অনুযায়ী ভারতীয় ইউনিয়ন ও পাকিস্তান নামক আলাদা দুটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে যায়। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তৎকালীন বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের অবদান ছিলো অপরিসীম। স্বাভাবিকভাবেই তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে ও দেশের সমৃদ্ধি অর্জনে নিরলসভাবে কর্মকান্ড পরিচালনা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। বাংলার জনগণের প্রত্যাশা ছিলো এ নবীন রাষ্ট্র পাকিস্তানে তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা সার্বিক মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার সুযোগ মিলবে।
কিন্তু কালের পরিক্রমায় তাদের সে স্বপ্ন-সাধ ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালে সর্বপ্রথম রাষ্ট্র ভাষা বিষয়ে বিতর্ক ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে যখন তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করলেন, “ টৎফঁ ধহফ টৎফঁ ধষড়হব ংযধষষ নব ঃযব ংঃধঃব ষধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ”  । এরই ধারাবাহিকতায়  ১৯৫২ -এর  ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি আর যুক্ত ফ্রন্টের বিজয় শাসক গোষ্ঠিকে জানান দিয়ে যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে দাবিয়ে রাখা যাবে না আর। এরপর বাঙ্গালীদের উপর নেমে আসে নির্যাতন-নিপীড়নের খড়গ। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবি নিয়ে রাজনীতির অঙ্গঁনে এক বৈপ্লবিক আন্দোলনের সূচনা করলে দেশের মানুষ জেগে ওঠে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে ঘটে যেতে থাকে অভাবনীয় পরিবর্তন। সামরিক আইন প্রশাসক ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পতন ঘটলে  ক্ষমতায় অধিষ্টিত হন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তাঁর অধীনে ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও শাসনভার আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তর না করে বরং নিরস্্র্্র বাংগালী নিধনে পাক সামরিক জান্তা শুরু করে দেয় ইতিহাসের নজিরবিহীন গণ হত্যা। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাংলার আপমর জনগণ। অবশেষে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলার স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিশ্¦ের মানচিত্রে জাতিরাষ্ট্র হিসাবে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের। স্বাধীন, সার্বভৌম, অসম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণ স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকে নিরলসভাবে কর্মকান্ড পরিচালনা করে যাচ্ছে দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণ সাধনে।

আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি আজ চার দশক অতিবাহিত হতে চলেছে। আমরা অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছি। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তান বানানোর পরিকল্পনা নিয়ে অত্যন্ত সুকৌশলে কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

আজ “ চারিদিকে নাগিণীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃস্বাস”। দেশ, জাতি, স্বাধীনতা আজ এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। যারা মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধীতা করেছিল, যারা অত্যাচারী পাক বাহিনীর দোসর হিসেবে বাংলার জনগণকে দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য দুশমনদের সহযোগিতা করেছিলো তারা আবার দেশে কাল নাগিণীর ফণা বিস্তার করে বাংলার স্বাধীনতা ধ্বংস করার কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করে চলেছে। অনতিবিলম্বে এদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করে এদের বিষদাঁত ভেঙ্গেঁ দিতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে হবে। যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার জনগণ স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ন হয়েছিল সে বোধ জাগ্রত করতে হবে আমাদের নবীণ প্রজন্মের মাঝে। আর এ জন্য স্কুল-কলেজ-বিশ্বাবদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সন্নিবেশিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে স্বাধীনতার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করতে হবে জনমনে। দেশ আজ এক সাংঘর্ষিক রাজনীতির আবর্তে নিপতিত। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও শিষ্টাচারের অভাব অত্যন্ত পীড়াদায়ক যা জাতির জন্য কোন শুভ লক্ষণ নয়। সকল রাজনৈতিক দলকে এ কথা মনে রাখতে হবে, দলের চাইতে দেশের স্বার্থকে উর্ধ্বে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে ব্যাক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়।

বিগত সরকারের আমলে জঙ্গীবাদের উত্থান হলেও বর্তমান সরকারের আমলে তাদেরকে দমন করা সম্ভবপর হয়েছে। কিন্তু  দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনও ধর্মান্ধ। সবাইকে মনে রাখতে হবে ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। সকল সম্প্রদায়কে একযোগে রাষ্ট্রের উন্নয়ন তথা স্বাধীনতা সুরক্ষার জন্য স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হ।ে

সবাইকে দলমতের উর্ধ্বে থেকে দেশ ও জাতির স্বার্থকেই প্রাধান্য দিতে হবে। দল নয় ক্ষমতা নয় দেশকেই ভালবাসতে হবে। দেশের কল্যাণকেই অগ্রাধীকার দিতে হবে জীবনের সকল ক্ষেত্রে। ঘুষ-দুর্নীতি সমাজদেহকে দূষিত করে ফেলেছে। কঠোর হস্তে দূর্নীতি দমন করতে হবে। এ ব্যাপারে কোন আপোষকামীতাকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। স্বাধীনতা সুরক্ষা তথা অর্থবহ করতে হলে দেশকে দারিদ্র ও নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হবে। দরিদ্র জনগণকে অর্থের প্রলোভনে ফেলে তাকে দিয়ে যে কোন অপকর্ম সাধন করা সহজ ব্যাপার। আর জনমনে যে পাকিস্তানী মানসিকতা এখনো সক্রিয় রয়েছে তা দূরীভূত করতে হলে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। শতভাগ মানুষকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত অধিকাংশ মানুষ এখোনো পাকিস্তান মনোভাবাপন্ন।  তথ্য মন্ত্রণালয়কে বিভিন্ন কর্মকান্ড- প্রদর্শনী ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের মন থেকে এ ভ্রান্ত মনোভাব দূরীভূত করার উদ্যোগ নিতে হবে অবিলম্বে। সর্বোপরি গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকরূপ দিতে হবে। গণতন্ত্রের রীতি-নীতি সবাইকে মেনে চলতে হবে।

সংক্ষেপে বলতে হয়, স্বাধীনতা অর্জন যেমন কঠিন  তাকে রক্ষা করা আরো কঠিন। প্রকৃতপক্ষে, জঙ্গীবাদ, মৌলবাদ, ধর্মন্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা জনমানস থেকে দূরীভূত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এটা যতক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিত করা যাবে না ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখীন থাকতে বাধ্য।



---০০০---

No comments:

Post a Comment